ভ্রমণ কাহিনী :: বগালেক, চিংড়ি ঝর্ণা ও কেওক্রাডং অভিযান

ভ্রমণ কাহিনী  :: বগালেক, চিংড়ি ঝর্ণা ও কেওক্রাডং অভিযান 


তাসলিম আলম তুহিন ।। বাংলাদেশের বৈচিত্র্য 

দেশের সবথেকে উঁচু পর্বত চূড়ায় দাঁড়িয়ে অনিন্দ্য সুন্দর ভুবনটাকে দেখার, মেঘ ফুঁড়ে উপরে উঠে সূর্যের সোনালী আলো মাখার বাসনাটা ছিল বহুদিন থেকেই । বিশুদ্ধ অক্সিজেনে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে কর্মক্লান্ত জীবনটাকে নবায়নের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি অনুভূত হচ্ছিল। সেই থেকেই কেওক্রাডং যাওয়ার ভাবনা মাথায় ভর করেছিল, কিন্তু বিভিন্ন ব্যস্ততার কারনে যাওয়া হয় নাই। গতবছর কয়েকবার কেওক্রাডং যাওয়ার পরিকল্পনা করি। বিভিন্ন ছুটির মাঝে চারবার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কি আর করার! এটা মেলেতো ওটা মেলেনা। এইভাবে কেওক্রাডং হয়ে ওঠে অধরা। এরই মধ্যে শুরু হল বিশ্বজুরে ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতি। সবকিছু লকডাউন। ঘরে বসে থাকা আর পরিকল্পনা করা। আবার কবে যেতে পারব পাহাড়ের সাথে মিতালি করতে। ছয় মাস প্রতিক্ষার পর আস্তে আস্তে অনেকটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি হয়ে আসলে আবার পরিকল্পনার দানা বাঁধতে থাকে। ফলে কেওক্রাডং আমাদের কাছে হয়ে ওঠে আরোও আকাঙ্খার বস্তু। ভ্রমন পিপাসু বন্ধুদের মধ্যে Partha Majumder এবং Sabbir Raihan Raihan ভাইয়ের উদ্যোগের কারণেই ভ্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। শেষমেষ ১০ সেপ্টেম্বর রাতে তারিখ নির্ধারন করা হয়। চলতে থাকে প্রস্তুতি। 
পর্বত চূড়ায় লেখক

কেওক্রাডং এর কথা শুনে অনেকেই যাওয়ার কথা বলতে থাকে। যতই সময় কাছাকাছি আসতে থাকে লোক সংখ্যা ততই কমতে থাকে। এটা ভ্রমণের একটা বৈশিষ্ট্য যে, যাওয়ার সময় সবাইকে পাওয়া যাবে না। তাই এইবার আমরা সিদ্ধান্ত নেই যেকয়জনই হোক আমরা আর পিছপা হব না। সবমিলিয়ে আমরা ১২জন হলাম। পার্থ বান্দরবানের বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ শুরু করলো। টিকিট কাটা, ভ্রমণ গাইড, কটেজ ভাড়া ইত্যাদি। সব ঠিকঠাক হচ্ছে আর সময় এগিয়ে আসছে। কেওক্রাডং যাওয়ার জন্য কিছু প্রস্তুতি নিতে হয়। যারা আগে কখনও পাহাড়ে যায় নি তাদের শারীরিক ফিটনেস দরকার, রাবারের আটকা জুতা, পায়ের এ্যাংকেলেট, রোদের জন্য টুপি, খাবার স্যালাইন এবং মাথাব্যথ্যা ও গা ব্যথার জন্য

 

কিছু ঔষধ। বর্ষার সময় প্রচুর জোক থাকে। শুনেছি জোকের উপদ্রপের জন্য সরিসার তেলের সাথে গুল (যা নেশা হিসাবে অনেকে খায়) মেখে লাগাতে হয়। এতে এর গন্ধে নাকি জোক ধরে না। যাই হোক আমি খুব জোক ভয় পাই তাই কাজ করুক বা না করুক সাথে এগুলো নিয়ে নিলাম। ১০ সেপ্টেম্বর রাত ১০টায় সায়েদাবাদ পৌঁছালাম। একে একে সবাই আসতে শুরু করলো। ঠিক সময়ে বাসে উঠে বসলাম। বাস ১১টার সময় ছাড়লো। প্রায় একঘন্টা পরে ২০মিনিটের একটা যাত্রা বিরতি- হালকা নাস্তা, চা এবং প্রকৃতির ডাকে সারা দিয়ে আবার বাস চলতে থাকলো গন্তব্যের দিকে। কিছু সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলাম পাহাড়ের স্বপ্ন দেখতে দেখতে। ভোর ৬টায় বাস এসে পৌঁছলো বান্দরবান। সকলে ফ্রেস হয়ে হালকা কিছু নাস্তা করে চাঁদের গাড়ি (ল্যান্ডক্রজার) এর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাদের সাথে ভ্রমন পিপাসু আরেক বন্ধু MD Jakir Hossain ভাই তিনি আমাদের জন্য মাঝে মাঝে চকলেট ও খেজুর দিয়ে আপ্যায়ন করান। তার আন্তরিকতা ভোলার নয়। সকল ট্যুরে থাকে তার আন্তরিক আপ্যায়ন। 





পরের গন্তব্য শৈলপ্রপাত ঝর্ণা ও রুমাবাজার। বান্দরবান থেকে চাঁদের গাড়িতে করে রওনা দিলাম সকাল ৮টায়। ৮ কিলোমিটার যেতে বান্দরবান-রুমা রোডে চোখে পড়লো শৈলপ্রপাত ঝর্ণা। জীপ গাড়ি থেকে নেমে শিড়ি বেয়ে ঝর্ণায় নামলাম। পর্যটন কর্তৃপক্ষ সিড়ি তৈরি করে দিয়েছে পর্যটকদের সুবিধার জন্য। বান্দরবান থেকে এটা কাছে হওয়ায় পর্যটকদের কাছে এটা খুব পরিচিত স্থান। এটা প্রকৃতিক সৈন্দর্য্যের অপরূপ সৃষ্টি। সারাক্ষন কূলকূল ধ্বনিতে মুখরিত করে রাখে পর্যটক ও রাস্তা থেকে যাওয়া আগন্তুকদের। এই প্রপাতের শিলাগুলো বেশ বড় বড় হওয়া এর উপর থেকে গড়িয়ে পড়ে পানি। তাই পাথর গুলো থাকে সব সময় পিচ্ছিল। পা পিছলে ঘটে যেতে পারে যেকোন সময় দূর্ঘটনা। তাই সাবধানে নামতে হয় এখানে। চাঁদে গাড়ি ছাড়াও বাসে যাওয়া যাবে রুমা বাজার কিন্তু বাসের জন্য অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে। বাসে রুমাবাজার যেতে ২.৫ থেকে ৩ ঘন্টা সময় লাগবে। পাহাড়ি রাস্তা উচু নিচু হওয়ায় প্রকৃতি দেখতে দেখতে যেতে চাইলে চাঁদের গাড়িতেই যাওয়া ভালো। তবে চাঁদের গাড়িতে ভাড়া অনেক বেশি। ১৫ সিট থাকে। পুরো গাড়ি ভাড়া করতে হবে। চাইলে আসা যাওয়া বা শুধু যাওয়া দুটোই করা যাবে। আমরা রুমা বাজার ২.৩০ ঘন্টার মধ্যে সকাল ১০টায় এসে পৌঁছালাম। বান্দরবান থেকে রুমা বাজার ৪৮ কিলোমিটার। রুমা বাজারে সকালের নাস্তা (ভাত, ডিম, আলু ভর্তা, ডাল) পরাটাও আছে কিন্তু অনেকটা পরিশ্রম হবে তাই পেট ভরে ভাত খেয়ে নিলাম। এই ফাঁকে আমাদের গাইড জসিম দুটো ফরম নিয়ে আসলো। চাকুরের ইন্টারভিউ এর মতো বিস্তারিত ফরম পূরন করলাম। এটার তিনটা ফটোকপি করা হলো। এর পরে আর্মি ক্যাম্পে গেলাম। একটা কপি দেখে তার এন্টি করলো। নাম স্বাক্ষর করে বেড়িয়ে পরলাম সাড়ে ১০টা নাগাদ। কিছুদূর যেতেই রুমা থানা সেখানে পুলিশের খাতায় এন্টি, নাম স্বাক্ষর করে আবার বেরিয়ে পড়লাম। অল্প কিছুদুর যেতেই অপরূপ সৌন্দর্য্য চোখের সামনে ধরা দিতে থাকলো। এই সৌন্দর্য্য কোন ক্যামেরায় বন্দি করা যায় না। অনেক ছবি তুলতে থাকলাম কিন্তু কিছুতেই চোখের সাথে ছবির মিল হচ্ছে না। শেষে প্রকৃতি দেখতে দেখতে ভুলে গেলাম ছবি তোলা। 

চিংড়ি ঝর্ণা

বগাকাইন হ্রদ বা বগালেক এরপর চলে আসলাম ওয়াই জংশন। এখানে আর্মি ক্যাম্প। আমাদের ন্যাশনাল আইডি কার্ড দেখাতে হলো এবং স্বাক্ষর দিয়ে আবার শুরু হলো যাত্রা। সামনে চলতে চলতে কখন যে সময় পার হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারচ্ছি না। পাহাড়ের ভাজে ভাজে মেঘ জমেছে। কোথাও দেখা যাচ্ছে বৃষ্টি। পাহাড়ি কন্যারা নেমে পড়েছে ঝুম চাষে। রাস্তার পাশ দিয়ে পাহাড়ি ঝুড়ি মাথায় দড়ি দিয়ে আটকিয়ে ঝুড়িতে নিয়ে যাচ্ছে কলা, পেপে, কুমড়া ইত্যাদি। চলে আসলাম আরেকটি আর্মি ক্যাম্প গেরিশন। এখানেও ব্যাগ চেক, নাম স্বাক্ষর শেষে আবার চলা শুরু চাঁদের গাড়ি। ধীরে ধীরে আমরা উঠে যাচ্ছি পাহাড়ে উপরে। অনেক গুলো পাহাড় টপকিয়ে ছুটে চলছি। কখনও পাহাড়ের গা বেয়ে কখনও পাহাড়ের উপর দিয়ে। কিছু সময় পড়ে সবচেয়ে খাড়া রাস্তা দিয়ে গাড়ি উঠেছে আবার নামছে। গা শিরশির করছে, মনে হচ্ছে এই বুঝি গাড়ি উল্টে পড়ে যাচ্ছে বা ডিগবাজি দিচ্ছে। প্রতিটি খাজে খাজে রয়েছে বিপদের ছায়া। দক্ষ হাতে ড্রাইভার চালিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। মাঝে মাঝে গাড়ি আর দম নিতে পারে না। মনে হয় এই বুঝি গাড়ি তার সর্বোচ্চ শক্তি শেষ করে থেমে যাবে। গায়ের শিহরন দিয়ে উঠছে বারবার। পৌঁছে গেলাম বগালেক। ১৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বগালেকে এসে বিমুগদ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছি। কি শোভা! কি রূপ! ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কিছু সময় পড়ে গাইডের ডাকে যেন চেতনা আসল। এখানে আর্মি ক্যাম্পে এন্টি করতে হবে। বগাকাইন হৃদ বা বগা লেগ সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ১,২৪৬ ফুট (৩৮০মিটার)। ফানেল বা চোঙ্গাকৃতির বগালেক দেখতে অনেকটা আগ্নেগিরির জ্বালামুখের মত। এটি নাইতং মৌজায় অবস্থিত। বগালেক পলিতাই পাহাড়ে অবস্থিত। অনেকের মতে এটি আগ্নেগিরি বা মহাকাশ থেকে উল্কাপিণ্ডের পতনে সৃষ্টি হয়েছে। এর গভিরতা ১২৫ ফুট (৩৮মিটার)। বগালেকে থাকা ও খাওয়ার সুবস্থা আছে। আমরা আজই কেওক্রাডং যাব তাই আর বগালেকে থাকা হয় নাই। এখানে নাস্তা খেয়ে কিছু শুকনা খাবার কিনে হাটা শুরু করলাম কেওক্রাডং এর উদ্দেশ্যে। এখানে থাকতে ও খেতে চাইলে আগে থেকে গাইডকে বলে রাখতে হবে। গাইড ব্যবস্থা করে রাখবে। বেশি ভারি ব্যাগ নেওয়া যাবে না ট্রেকিং এর জন্য। চাইলে বগালেকে ভারি ব্যাগ রাখার ব্যবস্থা আছে। পাহাড়ি পথে অনেক উচুতে উঠতে ও নামতে হবে। বৃষ্টি হলেতো কথাই নেই। পথ থাকে খুব পিচ্ছিল। তাছাড়া গরমের সময় এই পথ চলা অনেক কষ্টকর। তাপমাত্র থাকে অনেক বেশি। তবে সাথে খাবার স্যালাইন নিতে হবে। লতা ঝর্ণা ও চিংড়ি ঝর্ণা আমরা ১২টার দিকে রওয়ান হলাম। আকাশে অল্প অল্প মেঘ জমেছে। পথে হয়তো বৃষ্টির দেখা পাব। তারপরও মেঘের ফাঁকে ফাঁকে এত রোদের তাপ যে অল্প হাঠতেই গা থেকে ঘাম বের হতে লাগলো। এক কিলো হাটার পর দুটো রাস্তা দুই দিকে গেল। আমরা ডান দিকের ছোট পাহাড়ি রাস্তা ধরে চলতে থাকলাম। এর পর থেকে পাহাড় টাপকানোর পালা। ধিরে ধিরে উপরে ওঠা এবং নামা। পাহাড়ের পাশ দিয়ে কোথাও পথ এত খাড়া যে একটু অমনোযোগী হলেই খাদে পড়ে যেতে হবে। তাই মাথা নিচু করে অল্প অল্প কদম দিয়ে হাঠতে হচ্ছে। কোথাও একটু থেমে পাহাড়ের পাশের দৃশ্য দেখে আবার হাটা শুরু। এই রোমঞ্চ লিখে বা ছবি তুলে বোঝানো যাবে না। দূরে দেখা যাচ্ছে নীল গিরি পাহাড়ের নীল প্রাচির বীরদর্পে দাড়িয়ে আছে আকাশ ছোয়ার জন্য। তারি ফাঁকে জমেছে সাদা সাদা তুলার মত মেঘ। যেন কোন শিল্পি তার মনের মাধুরি দিয়ে এঁকেছে এই পাহাড়। না শিল্পিও এমন সুন্দর নিখুত ছবি আঁকতে পাড়বে না। 


প্রায় পৌনে এক ঘন্টা হাটার পর ছোট একটি ঝর্ণা। নাম তার ’লতা’। লতা ঝর্ণা থেকে পাড়ার লোকজন পানি সংগ্রহ করে। পরিস্কার পানি আমাদের ক্লান্তি দূর করলো। পাহাড়ে হাটার পথে এই ঝিড়ি ঝর্ণার পানি ও শব্দ ক্লান্তি দূর করে। একটু বিশ্রামের পরে আবার হাটা শুরু। পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে ওঠা, মাঝে মাঝে অল্প সমতল রাস্তা। বেশির ভাগ উপরে ওঠা। প্রায় আধা ঘন্টা হাটার পর দূর থেকে ঝর্ণার শব্দে মন আনচান করে ওঠলো। নাজানি কত বড় ঝর্ণা। অনেক দূর থেকে ঝর্ণার শব্দ আর পাহাড়ি ঝি ঝি পোকার ডাক সে এক মধুময় মায়াবি মনকাড়া শব্দ। এই প্রকৃতির সূর যেন মনে হয় স্বর্গ থেকে ভেসে আসছে। ধীরে ধীরে শব্দ আরোও গর্জে ওঠছে। কাছে আসতে দেখি ছোট একটা পানির ধারা। কিন্তু এত শব্দ এত পানি কোথা থেকে আসছে। বাম দিকে একটু একটু উপরে বড় বড় পিচ্ছিল পাথরের ফাঁক দিয়ে সাবধানে গেলেই দেখা যাবে সেই বিশাল চিংড়ি ঝর্ণা। উচু পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে পানি। প্রকৃত ঝর্ণাটা অনেক উপরে হওয়ায় এর প্রকৃত স্বাদ পেতে হলে ধীরে ধীরে পিচ্ছিল পাথর এ সাবধানে পা টিপে টিপে হাটতে হবে। সামনে উঠছি আর মাথা উচু করে উপরে তাকাছি। পাহাড়ের ফাঁকে গাছের পাতার মধ্য দিয়ে ডান দিকে তাকালে আরোও স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে চিংড়ি ঝর্ণা। পাগলা ঘোড়ার মতো ধেয়ে আসা ঝর্ণার পানি। ঝর্ণার পানি দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। প্রচণ্ড রোদে গরমে হেটে ক্লান্ত দেহ নিমেশেই বরফ শীতল ঠান্ডা পানিতে ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। সে এক রোমঞ্চকর অভিজ্ঞতা। অনেক ঝর্ণা দেখেছি। প্রতিটি ঝর্ণার স্বাধ, গন্ধ, রূপ আলাদা। প্রতিটি থেকে এটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে দাড়িয়ে আছে। এই ঝর্ণা দেখলে মনে হয় সব দুঃখ কষ্ট ধুয়ে সুখি ও পরিত্র মানুষ তৈরি করে তুলবে। চিংড়ি ঝর্ণার আশে পাশে প্রচুর গাছ-গাছালি থাকায় সে এক অপূর্ব আলোর লুকোচুরি। এরই ফাঁক থেকে রোদের আলো ঝর্ণার উপরে পড়ায় দেখা মিলছে এক অপরূপ রংধনু। সে কি শোভা, কিরূপ সাজে সেজেছে চিংড়ি ঝর্ণা। মন যেতে চাইছে না। তবু কেওক্রাডং যেতে হবে, হাঠতে হবে অনেকটা পথ। তাই গোছল সেরে আবার হাটা শুরু করলাম পাহাড়ি পথ ধরে। 



দার্জিলিং পাড়া থেকে কেওক্রাডং মোটামুটি ৪ ঘন্টার হাঁটা পথ। প্রথম এক কিলোমিটার পাকা রাস্তা, তারপর থেকেই পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে মাটির সরু পথ। দার্জিলিং পাড়া ও কেওক্রাডং চিংড়ি ঝর্ণায় প্রায় ঘন্টাখানেক কাটালাম। চিংড়ি ঝর্ণা থেকে নেমেই একটা উচু পাহাড়। পাহাড়টা বেশ খাড়া, স্থানীয়রা মাটি কেটে খাজ কেটে রেখেছে। খাজের ফাঁকে ঝর্ণা থেকে পায়ের পানিতে খাজ গুলো বেশ পিচ্ছিল হয়েছে। খুব সাবধানে ওঠতে হবে। একটু পা ফসকে গেলে মহাবিপদ। পাশেই গভির খাদ। ধীরে ধীরে উঠে একটু বিশ্রামের যায়গা। সেখানে কিছু শুকনা খাবার খেলাম সাথে খেজুর আর ঝর্ণা থেকে আনা ঠান্ডা পানি আমাদের ক্লান্তি দূর করল। আবার হাটা শুরু। এই হাটা যেন আর শেষ হচ্ছে না। শুধু হাটছি তো হাটছি, একসময় মনে হতে থাকলো এই বুঝি শ্বাসটা বেড়িয়ে যাচ্ছে। যতটা না পা ভাড়ি হচ্ছে তারচেয়ে বেশি হাপাচ্ছি । শুরু করলাম দম ছাড়া ও দম গ্রহণের ইয়োগা। কিছু সময় পরে মনে হচ্ছে এতেও কাজ হবে না। শুধু হা করে দম নিতে থাকি। রুমা বাজারে এক পুরাতন গাইডের সাথে দেখা হয়েছিল। উনি নাকি কেওক্রাডং প্রায় ২০০ বার উঠেছেন। এখন বয়সের কারনে আর ওঠেন না। তিনি আমাকে বলেছিলেন “নাক দিয়ে ধীরে ধীরে দম নিতে আর মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে দম ছাড়তে এবং ছোট ছোট পায়ের কদম দিতে হবে।” সেই অনুযায়ী চলছি। কিন্তু তাতে কি? কি পরিমান হাপাচ্ছি বুঝতে পারছিনা। আমরা দুপুর বেলাতে পাহাড়ে ওঠার কারনে খুব রোদ ও ভ্যাপসা গরমে হাসফাস করছি। তাই গরমের সময় পাহাড় ট্রেকিং এর জন্য উপযুক্ত সময় খুব ভোর ও বিকাল বেলা। আর শীত কালেতো কোন কথাই নেই। যাই হোক ঝি ঝি পোকার ডাক ও পাহাড়ের বাশ গাছের ঘর্ষনে বাতাসে তৈরি হচ্ছে এক অনাবিল সুর। এই কষ্ট দূর হচ্ছে পাহাড়ি ঝি ঝি পোকার ডাকে। এই সুর নিস্তব্ধতা ভেদ করে এক মায়াবি পথ তৈরি করেছে। নির্জনতার মধ্যে মাঝে মাঝে তবলার তালের মত সুর দিচ্ছে নাম না জানা পাহাড়ি পাখি। পাহাড়ের এক অনাবিল সৌন্দর্য্যরে রূপে মুগ্ধ হয়ে মাতালে মত সুরের পিছনে পিছনে হাটছি। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে পাহাড় আর আকাশের কোলাকুলি। পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে নিচের দিকে নেমে আসছে সাদা আকাঁবাকাঁ নাম না জানা ঝর্ণা। কিছুক্ষন পর পর বিশ্রাম নিচ্ছি। এসময় পাহাড়ি কিছু উপজাতিদের সাথে তাদের জীবন জীবিকা নিয়ে কথা হয়। ওদের আন্তরিকতায় আমরা বেশ মুগ্ধ। একসময় ওদের ভয় লাগতো। বিভিন্ন বাহিনি দ্বারা গুমের ঘটনা পত্রিকায় দেখে বেশ ভয় পেতাম। কিন্তু আজ ওদের জীবিকায় এসেছে পরিবর্তন। ওদের বাড়িতে এসেছে সৌর বিদ্যুৎ। প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঝর্না থেকে উপরে পানি ওঠাচ্ছে। এসেছে ডিস টিভি। দুর্গম পাহাড়ি পথে আজ এসেছে বিজ্ঞানের ছোয়া। পরিবর্তন এসেছে ওদের ব্যবহারে। দেখলাম কয়েকটি পাহাড়ি বালক ব্যাগের মধ্যে রাখা কোন যন্ত্র থেকে বিদেশি গান শুনতে শুনতে চলে যাচ্ছে। এখন তারা আর পাহাড়ি গান শোনে না। পাশ্চত্য গানে হাড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের পাহাড়ি সংস্কৃতি। তবে সব পাহাড়ি পাড়াতে এমনটা নয়। পাহাড়ি প্রায় সব পাড়া গুলো বেশ পরিচ্ছন্ন। প্রত্যেক উপজাতি প্রতিদিন তাদের পাড়া পরিস্কার করে। খারাপ লাগলো প্রতিটা বিশ্রামের স্থানে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া বিস্কুটের ও চিপ্্সের খোসা, পানির বোতল ইত্যাদি। এতো পরিচ্ছন্নতা অভিযান এতো আলোচনা তবু আমাদের মধ্যে সচেতনতার এত অভাব। তাইতো উপজাতিরা এগুলো পরিস্কার করে আর আমাদের গালাগাল দেয়। আসলেই খুব দুঃখজনক। প্রায় দুঘন্টা হাটলাম একটা একটা করে পাহাড় টপকাচ্ছি। মনে হচ্ছে এই বুঝি এসেগেছি। কিন্তু কই একটা থেকে আরেকটা পাহাড় বেশ উচু। মনে হতে লাগলো সমুদ্রের ঢেউরে চুড়াতে একবার উপরে উঠছি আবার নামছি। গরমে এবং দুপুর বেলা হওয়ায় আমরা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। 


দূর থেকে একটা উচু পাহাড় দেখতে পেলাম। এটাই কেওক্রাডং। কিন্তু এই পাহাড়ে যেতে অরোও কয়েকটি পাহাড় টপকাতে হবে। গা থেকে সমস্ত শক্তি বের হয়ে যাচ্ছে। আমাদের গাইড দেখাচ্ছে বহূদূরে একটা সাদা ঝর্ণা এর নাম ‘জিংসার সাইকার’। ক্যামেরা ঝুম করে দেখলাম ঝর্ণাটি। দূর থেকে আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে লাগলো ‘কেওক্রাডং’। সেই কাঙ্খিত স্বপ্নচূড়া। কিন্তু ভয় লাগছে এটা দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি এখনও কিভাবে ওই উচু পাহাড়ে উঠবো। পাশ থেকে দেখছি এক পাহাড়ি বৃদ্ধা বেশ থরথর করে হেটে চলছে। বাঙ্গালি হলে হয়তো এই বয়সে বিছানায় থাকতো নয়তো হাসপাতালে। তাকে দেখে আবার শক্তি ফিরে পেলাম। শুরু হলো আবার হাটা। আবার পাহাড় টাপকানো। গাইড বললো আরো দুটো পাহাড় বাইতে হবে। বেলুনের মত দম ফুস করে বের হয়ে গেল। পা চলতেই চাচ্ছে না। তিন ঘন্টা হাটা হয়ে গেল। একটা মোড় ঘুরতেই চোখে পড়লো কয়েকটি ঘর মনে হলো এটাই কেওক্রাডং। কিন্তু না, গাইড বললো এটা ‘দার্জিলিং পাড়া’। ‘দার্জিলিং পাড়া’ বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পাড়া বলা হয়। তবে আরোও কয়েকটি পরিচ্ছন্ন পাড়া দেখেছি। বিশেষ করে ‘বম’ সম্প্রদায় পাড়াগুলো বেশ পরিচ্ছন্ন হয়। তারা সকলেই মিলে পাড়া পরিস্কার করে। আমাদের কিছু অমানুষ ওখানে গিয়ে নোঙ্ড়া করে রাখে। দার্জিলিং পাড়াকে বলা যেতে পারে কেওক্রাডং এর একটা ‘বেসক্যাম্প’। এই পাড়াতে একটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। বম সম্প্রদায় খ্রিষ্টান হওয়া এখানে বেশ বড় একটি চার্জ আছে। আছে বেশ কয়েকটি দোকান এখানে চা থেকে শুরু করে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে ভাত খেতে চাইলে আগে গাইডকে বলে রাখতে হবে। আমরা দুপুরের খাবার এখানে খেলাম। চিংড়ি ঝর্ণাতে অনেক সময় দিয়েছি আবার পাহাড়ি পথে অনেক বার বিশ্রাম নিয়েছি তাই আমাদের দার্জিলিং পাড়ায় পৌছাতে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা লেগেছে। ভোর বেলায় রওয়ানা দিলে এত সময় লাগতো না। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রাম নিলাম। এখনও প্রায় ৪০ থেকে ৫০ মিনিট সময় লাগবে কেওক্রাডং যেতে। হাতের নাগালেই হওয়া এখন কষ্ট মনে হচ্ছে না। দার্জিলিং পাড়ায় খাওয়া ও বিশ্রাম শেষে আবার হাটা শুরু করলাম স্বপ্নচূড়ায় উঠতে। একটু সামনে যেতেই দেখি আগের তুলনায় বেশ খাড়া পাহাড়। তখন মনে হচ্ছে রাজাদের ভাব যেমন রাজা রাজা তেমনি কেওক্রাডং এর ভাব ও রাজা রাজা। এত বড় পাহাড় তার একটা ভাব থাকবে না, তা কি হয়? বোঝা গেল হাটা শুরু করার পর। এই সাড়ে তিন ঘন্টা হেটে যে কষ্টটাই না হয়েছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে এই ৪০ -৫০ মিনিটের পথ পড়ি দিতে। কোথাও প্রায় ৭০০ খাড়া পাহাড়ে উঠঠে হচ্ছে। শুধু উপরে উঠছিতো উঠছি যেন শেষ হচ্ছে না। মনে হয় আকাশ নেমে আসছে আমাদেরে হাতের নাগালে। দিগন্ত নেমে এসেছে পাহাড়ের পাদদেশে। আর মেঘগুলো ছুয়ে যাচ্ছে আমাদের ক্লান্তি দূর করতে। বেশ খাড়া হওয়ায় ধীরে ধীরে উঠতে হচ্ছে। পা আর চলছে না। এত সময়ের ক্লান্তি যেন আরোও ঝাপটে ধরেছে। মনে হচ্ছে ক্লান্তির বোঝা ‘জুজু বুড়ির’ মত ঘাড়ে বসে আছে। আর উপরে ওঠতে পারচ্ছি না। পাহাড় দেখছি আর হাটছি। একটু দাড়িয়ে দূর দিগন্তে তাকিয়ে দেখছি। তখন বোঝা যাচ্ছে কতটা উপরে উঠেছি। শরীর থেকে সব অক্সিজেন বের হচ্ছে। আস্তে আস্তে পৌছে গেলাম কেওক্রাডং। এই কষ্ট ভুলে অপরূপ নয়নে দিখছি দিগন্ত রেখা। পাখির চোখে পৃথিবীকে দেখছি নয়ন ভরে। কি ছবি তুলবো! কি ভিডিও করব! শুধু দু চোখ ভরে তাকিয়ে দেখছি সৃষ্টির অপরূপ খেলা। অল্প সময়ের মধ্যে একটা ছোট মেঘ এসে আমাদের গায়ে ঠান্ডা হিম ছুয়িয়ে আলিঙ্গন করে অভ্যার্থনা করে গেল। চার পাশ মেঘের চাদরে ঢেকে গেল। এত কষ্ট করে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে ওঠলাম আর মেঘে ঢেকে যাবে চার পাশ প্রকৃতি দেখতে পাবনা! কিন্তু না, কয়েক মিনিটের মধ্যে আমাদের আলিঙ্গন করে সাদা মেঘ আবার উড়ে গেল গাঙচিলের মত অজানায়। আকাশ লাল করে দেখতে দেখতে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছে সূর্য মামা। পাহাড়ের উপর থেকে সূর্যাস্ত দেখা এক অপরূপ শোভা। 


‘কেওক্রাডং’ শব্দটি ‘মারমা ভাষা থেকে এসেছে। মারমা ভাষায় ‘কেও’ মানে ‘পাথর’ ‘কাড়া’ মানে ‘পাহাড়’ আর ‘ডং’ মানে ‘সবচেয়ে উঁচু’। অর্থাৎ ‘কেওক্রাডং’ এর অর্থ দাড়ায় ‘সবচেয়ে উঁচু পাথরের পাহাড়’। এই পাহাড়ের চুড়ায় সেনাবাহিনী কর্তৃক উৎকীর্ণ যে ফলক দেখা যায় তাতে এর উচ্চতা লেখা হয়েছে ৩,১৭২ ফুট। জিপিএস সমীক্ষায় উচ্চতা পাওয়া গেছে ৯৭৪ মিটার (৩,১৯৬ফুট)। রাতে এখানে থাকবো। একটু পড়েই নামতে শুরু করল শীত। শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। এত গরমের মধ্যেও রাতের বেলা কম্বল দিয়ে শুতে হয়েছে। পূর্ণমা রাত হলে সেটা হতে স্বর্গসুখ। ভোরবেলা দেখলাম সূর্য উদয়ের দৃশ্য। এখনও মনে হচ্ছে লাল ডিমের কুসুমের রক্তিম আভা ছড়িয়ে আমাদের আলোকিত করতে বেরিয়ে আসছে সূর্য। এবার ফেরার পালা। ভালো থেকো কেওক্রাডং, ভালো থেকো মেঘ, পাখ-পাখালি বন।




Comments

  1. Thanks a lot, brother for great adventure & amazing tour experience share.nice ur writing.

    ReplyDelete
  2. Thanks a lot, brother for ur writing of Bandarban tour. it was a really great adventure & an amazing tour.

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

HATIYA ISLAND || THE TRANQUILITY OF THE ESTUARY

THE PRIDE OF BANGLADESH || MUJIBNOGOR COMPLEX